No products in the cart.
কফির ইতিহাস শুরু হয় ইথিওপিয়ার ক্যালডি ছাগল পালকের আবিষ্কারের মাধ্যমে, এরপর আরব, ইউরোপ, এবং বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে এটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এবং অর্থনৈতিক বিপ্লবের সূচনা করে, এবং আজকের দিনে এসপ্রেসো, ইনস্ট্যান্ট কফি ও কফি শপ সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে, বিকেলের আড্ডায় বা কাজের ফাঁকে অলসতা কাটাতে, কফি ছাড়া অনেকের দিনটাই যেন জমে না। আমাদের হাতে থাকা গরম কফির মগটা এখন এতটাই সাধারণ, যে হয়তো ভাবিই না এর পেছনে লুকিয়ে আছে কত দীর্ঘ এবং রোমাঞ্চকর একটি ইতিহাস।
এই যে প্রতিদিন আমরা কফি খাই, এর যাত্রাটা কিন্তু হাজার হাজার বছর আগের। একটা সাধারণ পাহাড়ি ফল থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই বস্তুতে পরিণত হওয়ার গল্পটা সিনেমার কাহিনীর চেয়ে কম কিছু নয়। চলুন, আজ সেই গল্পটাই শুনি।
কফির জন্ম নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটা আমাদের নিয়ে যায় আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ার এক সবুজ পাহাড়ি অঞ্চলে, প্রায় নবম শতকে। ক্যালডি নামের এক ছাগল পালক একদিন দেখল, তার ছাগলগুলো এক ধরনের অচেনা গাছের লাল টুকটুকে ফল খেয়ে অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি লাফালাফি করছে। তাদের শরীরে যেন অফুরন্ত শক্তি চলে এসেছে।
কৌতূহলী হয়ে ক্যালডি নিজেও কয়েকটা ফল চেখে দেখল। আর সাথে সাথেই তার নিজের ক্লান্তি দূর হয়ে শরীরে দারুণ এক ফুর্তি চলে এল। এই আশ্চর্য ফলের কথা সে কাছের এক মঠের সন্ন্যাসীকে জানাল।
সন্ন্যাসী প্রথমে ফলগুলোকে খারাপ কিছু ভেবে আগুনে ফেলে দিলেন। কিন্তু আগুনে পোড়ার পর বিনগুলো থেকে এমন সুন্দর একটা গন্ধ বের হতে শুরু করল যে, তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি পোড়া বিনগুলো গরম পানিতে মিশিয়ে সেই পানি পান করে দেখলেন। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, সেই পানি পান করার পর তিনি সারা রাত জেগে প্রার্থনা করতে পারলেন, তার কোনো ঘুম এলো না।
এভাবেই নাকি কফির জন্ম। এই গল্পটা সত্যি হোক বা না হোক, এটা নিশ্চিত যে কফির যাত্রা শুরু হয়েছিল ইথিওপিয়ার সবুজ মালভূমিতে।
ইথিওপিয়া থেকে কফি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে আরব উপদ্বীপে। বিশেষ করে ইয়েমেনে এর চাষাবাদ শুরু হয়। আরবরাই প্রথম কফি বিন রোস্ট করে এবং গুঁড়া করে আজকের মতো করে খেতে শুরু করে। তারা এর নাম দেয় “কাহওয়া” (Qahwa), যার অর্থ “যা ঘুম তাড়ায়”।
আরব দেশগুলোতে কফি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সুফি-সাধকরা সারা রাত জেগে ইবাদত করার জন্য কফি পান করতেন। ধীরে ধীরে মঠ থেকে কফি সাধারণ মানুষের কাছে চলে আসে। জন্ম নেয় “কাহওয়া খানেহ” বা কফি হাউজ। এই কফি হাউজগুলো শুধু কফি খাওয়ার জায়গা ছিল না, এগুলো হয়ে উঠেছিল জ্ঞান, সংস্কৃতি আর সামাজিক আলোচনার কেন্দ্র। মানুষ এখানে বসে দাবা খেলত, গান শুনত আর দেশের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। সেই সময়ে, এটি ছিল সামাজিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু।
আরবরা কফিকে তাদের নিজেদের সম্পদ মনে করত এবং এর চাষাবাদের পদ্ধতি খুব গোপন রাখত। তারা কোনো উর্বর কফি বিন আরবের বাইরে যেতে দিত না, যাতে অন্য কেউ এর চাষ করতে না পারে।
সতেরো শতকের দিকে, ইউরোপীয় বণিকদের হাত ধরে কফি প্রথম ইউরোপে পৌঁছায়। প্রথমে ভেনিসের ব্যবসায়ীরা কফি নিয়ে আসে এবং এটা খুব দ্রুত ইউরোপের মানুষের মন জয় করে নেয়।
কিন্তু ইউরোপে কফির যাত্রাটা সহজ ছিল না। অনেকে একে “শয়তানের পানীয়” বা “মুসলমানদের মদ” বলে এর বিরোধিতা শুরু করে। ব্যাপারটা এতদূর গড়ায় যে, পোপ অষ্টম ক্লেমেন্টের কাছে এর বিচার যায়। পোপ নিজে কফি পান করে এর স্বাদে এতটাই মুগ্ধ হন যে, তিনি একে শয়তানের বদলে “খ্রিস্টানদের পানীয়” হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপর আর কফিকে ঠেকায় কে!
ইউরোপের বড় বড় শহর যেমন লন্ডন, প্যারিস, ভিয়েনায় দ্রুত কফি হাউজ গড়ে উঠতে শুরু করে। লন্ডনের কফি হাউজগুলোকে “পেনি ইউনিভার্সিটি” বলা হতো, কারণ মাত্র এক পেনি দিয়ে এক কাপ কফি কিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্ঞানী-গুণী মানুষের আলোচনা শোনা যেত। এই কফি হাউসে ব্যবসা গড়ে উঠত, আইডিয়া বিনিময় হতো, আর কখনো কখনো বিপ্লবের পরিকল্পনাও করা হতো।
ইউরোপীয় কলোনিগুলোর মাধ্যমে কফি খুব দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ডাচরা প্রথম আরবের বাইরে কফির চাষ শুরু করে। তারা জাভা (ইন্দোনেশিয়া) এবং শ্রীলঙ্কায় কফির বাগান তৈরি করে। এরপর ফরাসিরা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং ল্যাটিন আমেরিকায় কফির চাষ শুরু করে।
ব্রাজিলে কফির আগমন নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। ফরাসিরা তাদের কফি গাছ খুব সাবধানে পাহারা দিত। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান এক কর্নেল এক ফরাসি গভর্নরের স্ত্রীর মন জয় করে তার কাছ থেকে উপহার হিসেবে এক তোড়া ফুলের ভেতরে লুকিয়ে কয়েকটি কফি চেরি নিয়ে আসেন। সেই কয়েকটি চেরি থেকেই আজকের ব্রাজিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় কফি উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে।
উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে কফি শিল্পে অনেক নতুন প্রযুক্তি আসে, যা কফিকে সাধারণ মানুষের আরও কাছে নিয়ে যায়।
এসপ্রেসো মেশিন: ১৯০১ সালে ইতালিতে লুইজি বেজ্জেরা প্রথম এসপ্রেসো মেশিন আবিষ্কার করেন। এই মেশিন দিয়ে খুব দ্রুত আর কড়া কফি তৈরি করা যেত, যা কফি শপগুলোর জন্য একটা বিপ্লব ছিল। ল্যাটে, ক্যাপুচিনোর মতো কফি কালচারের জন্ম এই এসপ্রেসো থেকেই।
ইনস্ট্যান্ট কফি: ১৯১০ সালে জর্জ ওয়াশিংটন নামের একজন আমেরিকান প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ইনস্ট্যান্ট কফি তৈরি করেন। শুধু গরম পানির সঙ্গে মেশালেই কফি তৈরি হয়ে যেত, এই সহজ পদ্ধতিটা কফিকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। বিশেষ করে বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের মধ্যে ইনস্ট্যান্ট কফি খুবই জনপ্রিয় ছিল।
কফি চেইন শপ: ১৯৭০-এর দশকে স্টারবাকসের মতো কফি চেইন শপের জন্ম হয়। তারা কফিকে শুধু একটি পণ্য হিসেবে না দেখে, এক ধরনের “অভিজ্ঞতা” হিসেবে বিক্রি করতে শুরু করে। সুন্দর পরিবেশ, নানা ধরনের ফ্লেভার এবং ভালো কাস্টমার সার্ভিস – এসব মিলে কফি শপগুলো আধুনিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
এক কাপ কফির পেছনের এই দীর্ঘ ইতিহাস আমাদের এটাই বলে যে, কফি শুধু আমাদের ঘুম তাড়ানোর কোনো পানীয় নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি আর সামাজিকতার গল্প। ইথিওপিয়ার এক সাধারণ ছাগল পালকের আবিষ্কার থেকে শুরু করে আজকের গ্লোবাল কফি চেইন যা সত্যিই অসাধারণ।
তো, পরেরবার যখন একটি গরম কফির মগ হাতে নিবেন, এক মুহূর্ত থেমে ভাবুন। আপনার হাতে থাকা এই মগের পেছনে লুকিয়ে আছে কত দেশের ইতিহাস, কত মানুষের পরিশ্রম এবং কত বিপ্লবের গল্প। তখন আপনার কফি উপভোগের মুহূর্তটা আরও বিশেষ ও অর্থবহ হয়ে উঠবে। আপনার পরের কাপ কফি হোক এই অসাধারণ ইতিহাসের প্রতি সম্মান জানিয়ে।
আরও পড়ুন: কফি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা।