No products in the cart.
আমরা প্রতিদিন সকালে যে কফিটা আয়েশ করে খাই, তার পেছনের গল্পটা কিন্তু বেশ লম্বা আর অনেক পরিশ্রমের। এটা শুধু গরম পানিতে মেশানো কোনো গুঁড়া নয়। এর যাত্রা শুরু হয় একটা ছোট্ট বীজ থেকে, যা একজন চাষির পরম যত্নে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যত্ন নেওয়ার পরেই সেই গাছ ফল দেয়।
কফির এই পুরো জার্নিটা, বীজ থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত, সত্যি দারুণ। চলুন, আজ সেই গল্পটাই শুনি। কীভাবে একটা বীজ থেকে গাছ হয়, আর সেই গাছ থেকে কফি চেরি পেড়ে আমাদের কাপ পর্যন্ত পৌঁছায়, তার পুরো প্রক্রিয়াটা সহজ করে জেনে নেওয়া যাক।
কফির জীবনচক্র শুরু হয় একটা বীজ থেকে। তবে এই বীজ কিন্তু আমরা দোকানে যে ভাজা বিন দেখি, সেটা নয়। এটা হলো সবুজ, কাঁচা কফি বিন। ভালো মানের কফি চাষের জন্য ভালো জাতের বীজ বেছে নেওয়া খুব জরুরি।
বীজগুলো প্রথমে নার্সারির বিশেষ ছায়াযুক্ত বিছানায় রোপণ করা হয়। সেখানে মাটি, সার আর পানির সঠিক মিশ্রণে বীজগুলোকে যত্ন করে রাখা হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বীজ থেকে অঙ্কুর বের হয় আর ছোট ছোট চারাগাছ জন্মাতে শুরু করে। এই চারাগুলোকে বলা হয় ‘seedlings’।
এই চারাগাছগুলো নার্সারিতে প্রায় ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত বড় হয়। যখন গাছগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী আর সতেজ হয়ে ওঠে, তখন সেগুলোকে মূল বাগানে লাগানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়। এটা খুব সূক্ষ্ম একটা প্রক্রিয়া, কারণ এই শুরুর ধাপটাই গাছের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
নার্সারি থেকে এনে চারাগাছগুলো মূল বাগানে সারি সারি করে লাগানো হয়। কফি গাছ লাগানোর জন্য আবহাওয়া আর মাটি দুটোই খুব জরুরি। উঁচু পাহাড়ি এলাকা, যেখানে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয় আর মাটি উর্বর থাকে, সেখানে কফি গাছ সবচেয়ে ভালো জন্মায়।
গাছ লাগানোর পরেই শুরু হয় আসল যত্নের পালা।
পানি সেচ: কফি গাছের জন্য নিয়মিত পানি দরকার, তবে অতিরিক্ত পানি গাছের গোড়ায় জমলে শেকড় পচে যেতে পারে। তাই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো হওয়া প্রয়োজন।
সার প্রয়োগ: গাছের সঠিক বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সার দিতে হয়। চাষিরা সাধারণত গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী জৈব আর রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন।
আগাছা পরিষ্কার: গাছের গোড়ায় আগাছা জন্মালে তা গাছের খাবার আর পানি শুষে নেয়। তাই নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করা জরুরি।
ছাঁটাই (Pruning): গাছগুলো বড় হতে শুরু করলে সেগুলোকে ছেঁটে দেওয়া হয়। এতে গাছগুলো একদিকে যেমন নির্দিষ্ট আকারে থাকে, অন্যদিকে নতুন ডালপালা গজায় আর ফলের ফলন বাড়ে।
একটা কফি চারা লাগানোর পর ফল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে প্রায় ৩ থেকে ৪ বছর সময় লাগে। ভাবুন তো, আপনার এক কাপ কফির পেছনের গাছটার বয়স হয়তো আপনার থেকেও বেশি!
গাছ যখন পরিণত হয়, তখন তাতে ফুল আসতে শুরু করে। সাধারণত, বর্ষাকালের পরেই কফি গাছে সাদা রঙের সুন্দর ফুল ফোটে। এই ফুলগুলো থেকে জেসমিন ফুলের মতো মিষ্টি একটা গন্ধ বের হয়, যা পুরো বাগানকে ভরিয়ে তোলে।
তবে এই ফুলের আয়ু খুব কম, মাত্র কয়েক দিন। ফুলগুলো ঝরে যাওয়ার পরেই সেই জায়গা থেকে ফল ধরতে শুরু করে। এই ফলগুলোকেই বলা হয় কফি চেরি। প্রথমে এগুলো সবুজ থাকে, আর ধীরে ধীরে পাকতে শুরু করে। জাত আর ভ্যারাইটি অনুযায়ী, পাকলে এগুলোর রঙ টকটকে লাল, হলুদ বা গাঢ় বেগুনি হয়ে যায়।
এই চেরি পাকার প্রক্রিয়াটা বেশ সময়সাপেক্ষ। ফুল ফোটার পর চেরি পুরোপুরি পাকতে প্রায় ৮ থেকে ৯ মাস সময় লাগে।
কফি চাষের সবচেয়ে কঠিন আর শ্রমসাধ্য কাজ হলো ফসল তোলা বা হার্ভেস্টিং। কারণ একটা গাছে বা একই ডালে সব চেরি একসাথে পাকে না। কিছু পাকে, কিছু কাঁচা থাকে। তাই ভালো মানের কফি পাওয়ার জন্য শুধু পাকা ফলগুলোই তুলতে হয়।
কফি চেরি তোলার মূলত দুটো পদ্ধতি আছে।
এই পদ্ধতিতে চাষিরা হাত দিয়ে বেছে বেছে শুধু পাকা লাল চেরিগুলোই গাছ থেকে তোলেন। এটা খুবই সময়সাপেক্ষ আর পরিশ্রমের কাজ। চাষিদের একই গাছে বেশ কয়েকবার আসতে হয়, কারণ সব ফল একসাথে পাকে না।
এই পদ্ধতিতে যেহেতু শুধু সেরা মানের পাকা ফলই সংগ্রহ করা হয়, তাই স্পেশালিটি কফির জন্য এভাবেই হার্ভেস্ট করা হয়। এটা নিশ্চিত করে সর্বোচ্চ মান, আর এই কারণেই ভালো কফির দাম একটু বেশি হয়।
এই পদ্ধতিতে গাছের একটা ডালের সব ফল, কাঁচা-পাকা নির্বিশেষে, একবারে টেনে তুলে নেওয়া হয়। এটা হাতেও করা যায়, আবার মেশিন দিয়েও করা যায়। এই উপায়টা অনেক দ্রুত আর কম খরচের।
তবে এই পদ্ধতিতে পাকা ফলের সাথে অনেক কাঁচা আর বেশি পেকে যাওয়া ফলও চলে আসে, যা কফির মান কমিয়ে দেয়। বাণিজ্যিক বা কমার্শিয়াল গ্রেডের কফির জন্য সাধারণত এই পদ্ধতিটাই ব্যবহার করা হয়।
ফসল তোলার পরেই কিন্তু কফির কাজ শেষ নয়। বরং আসল প্রক্রিয়াজাতকরণ তো এরপরই শুরু হয়। সংক্ষেপে, তোলা চেরিগুলোকে শুকিয়ে, খোসা ছাড়িয়ে, গ্রেডিং করে তারপর রোস্ট করা হয়। সেই রোস্ট করা বিন গুঁড়ো করেই তৈরি হয় আমাদের উপভোগ করার মতো কফি।
কফির বীজ থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত এই পুরো যাত্রাটা ধৈর্য, শ্রম আর ভালোবাসার গল্প। একজন চাষির কয়েক বছরের পরিশ্রম লুকিয়ে থাকে আমাদের প্রতিদিনের এক মগ কফিতে। এই পুরো প্রক্রিয়াটা জানলে কফির প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা দুটোই বেড়ে যায়।
তাই, পরের বার যখন প্রিয় কফিটা চুমুক দেবেন, একটু ভাবুন। এর দারুণ স্বাদের পাশাপাশি এর পেছনের গল্পটাও ভাবুন। ভাবুন সেই চাষির কথা, যার যত্নে এই কফি আপনার হাতে এসে পৌঁছেছে। আপনার কফি পানের মুহূর্তটা তখন আরও বেশি স্পেশাল হয়ে উঠবে।
আরো পড়ুন: কফির ইতিহাস।