No products in the cart.
কফির স্বাদে টেরোয়ারের ভূমিকা হলো মাটি, আবহাওয়া, উচ্চতা ও টপোগ্রাফির সমন্বয়ে কফি বিনের স্বাদ নির্ধারণ, যা প্রতিটি অঞ্চলের বিশেষত আগ্নেয়গিরির মাটি, উচ্চতায় পাকার সময়, এবং নির্দিষ্ট ক্লাইমেটের প্রভাবের মাধ্যমে স্বাদে ফ্লোরাল, ফলমূলের বা মাটির মতো ভিন্ন ভিন্ন গুণ যুক্ত করে।
আমরা যখন কফি কিনি, প্যাকেটের গায়ে লেখা দেখি— “Ethiopian Yirgacheffe,” “Colombian Supremo,” “Sumatra Mandheling“। এই নামগুলো শুধু দেশের নাম নয়, এগুলো কফির স্বাদের একটা পরিচয়। কখনো কি ভেবেছেন, কেন ইথিওপিয়ান কফির স্বাদ ব্লুবেরির মতো মিষ্টি হয়, আর কেনই বা সুমাত্রার কফি হয় মাটির মতো ভারী?
এর রহস্য লুকিয়ে আছে একটা শব্দে তা হলো ‘Terroir’। তবে এটা শুধু মাটির কথা না; বরং একটা অঞ্চলের মাটি, আবহাওয়া, উচ্চতা আর চাষ পদ্ধতির মিশ্রণে তৈরি এক অনন্য পরিচয়। Terroir-ই ঠিক করে দেয়, আপনার কাপের কফির স্বাদটা কেমন হবে। এটা হলো কফির জন্মস্থান বা উৎপত্তির একদম আলাদা স্বাদের ছাপ।
চলুন, আজ কফির এই terroir রহস্যটা সহজ করে জেনে নিই। কীভাবে মাটি, আবহাওয়া আর উচ্চতা মিলে আপনার কফির স্বাদকে জাদুকরী করে তোলে, সেই গল্পটাই আজ শোনাব।
Terroir শব্দটা মূলত ওয়াইন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার হতো। এটা দিয়ে বোঝানো হতো, একটা আঙুরের স্বাদ তার চারপাশের পরিবেশের ওপর কতটা নির্ভরশীল। এখন এই ধারণাটা কফির জগতেও খুব জনপ্রিয়। কারণ, কফি বিনও একটা ফলের বীজ, আর এর স্বাদও তার পরিবেশ দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়।
Terroir-এর প্রধান উপাদানগুলো হলো:
মাটি (Soil): মাটির খনিজ উপাদান।
আবহাওয়া (Climate): তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত আর সূর্যালোক।
উচ্চতা (Altitude): সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কতটা উঁচুতে কফি চাষ হচ্ছে।
টপোগ্রাফি (Topography): জমির ঢাল আর অবস্থান।
এই সবকিছু মিলে একটা কফি বিনের ভেতরে তার নিজস্ব ফ্লেভার প্রোফাইল তৈরি করে। তাই, যখন আপনি কফির স্বাদ নিচ্ছেন, আসলে আপনি তার জন্মভূমির স্বাদই অনুভব করছেন।
চলুন, terroir-এর প্রত্যেকটা উপাদান কীভাবে কফির স্বাদে আলাদা আলাদা মাত্রা যোগ করে, তা ভেঙে দেখি।
স্পেশালিটি কফির জগতে একটা কথা প্রচলিত আছে— “উচ্চতা যত বেশি, কফির বীজের মান তত ভালো হয়“। উঁচু পাহাড়ি এলাকায় জন্মানো কফি বিনের স্বাদ সাধারণত বেশি জটিল আর আকর্ষণীয় হয়।
কেন এমন হয়? উঁচু এলাকায় তাপমাত্রা কম থাকে আর রাতগুলো বেশ ঠান্ডা হয়। এই পরিবেশে কফি চেরি পাকে খুব ধীরে ধীরে। বেশি সময় ধরে পাকার কারণে বিনের ভেতরে চিনি আর অ্যাসিডের পরিমাণ বাড়ে, যা এর স্বাদকে আরও মিষ্টি, ঝরঝরে আর জটিল করে তোলে।
স্বাদের পার্থক্য:
উচ্চ উচ্চতা (৪,০০০-৬,০০০+ ফিট): এই উচ্চতায় চাষ হওয়া কফিতে ফ্লোরাল, ফলের মতো স্বাদ এবং উজ্জ্বল অ্যাসিডিটি পাওয়া যায়। স্বাদ হয় অনেক কমপ্লেক্স। ইথিওপিয়া, কেনিয়া আর কলম্বিয়ার সেরা কফিগুলোই সাধারণত এই উচ্চতায় চাষ হয়।
নিম্ন উচ্চতা (২,৫০০ ফিটের নিচে): নিচু এলাকায় চাষ হওয়া কফি তাড়াতাড়ি পেকে যায়। এর স্বাদ হয় মাইল্ড, নরম এবং মাটির মতো। এতে অ্যাসিডিটি কম থাকে আর বডি হয় বেশ ভারী। ব্রাজিলের অনেক কফিই এই ধরনের।
কফি গাছ তার প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান মাটি থেকে সংগ্রহ করে। তাই, মাটির ধরন আর খনিজ উপাদান কফির স্বাদে বড় ভূমিকা রাখে।
আগ্নেয়গিরির মাটি (Volcanic Soil): মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক কফি আগ্নেয়গিরির ঢালে চাষ হয়। এই মাটি নাইট্রোজেনসহ নানা খনিজ পদার্থে ভরপুর থাকে। আগ্নেয়গিরির মাটিতে জন্মানো কফির স্বাদ হয় সমৃদ্ধ, গভীর (rich, deep) এবং এতে থাকে একটা মসৃণ অ্যাসিডিটি। Guatemala Antigua কফি এর দারুণ উদাহরণ।
লাল ল্যাটেরাইট মাটি (Red Laterite Soil): আফ্রিকার কিছু অংশে এবং ব্রাজিলে এই ধরনের মাটি দেখা যায়। এই মাটিতে আয়রন আর অ্যালুমিনিয়াম বেশি থাকে, যা কফিকে একটা earthy বা মাটির মতো আর ফলের মতো স্বাদ দেয়।
মাটির স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ সরাসরি কফির বীজের মানকে প্রভাবিত করে। সুস্থ মাটি মানে স্বাদে সমৃদ্ধ কফি।
কফি চাষের জন্য একটি নির্দিষ্ট আবহাওয়া প্রয়োজন। এই এলাকা কে বলা হয় ‘The Bean Belt’। এটি হলো নিরক্ষরেখার কাছাকাছি এমন একটি অঞ্চল, যেখানে তাপমাত্রা, বৃষ্টি এবং সূর্যালোকের পারফেক্ট ব্যালেন্স থাকে।
বৃষ্টিপাত (Rainfall): কফি গাছের জন্য নিয়মিত বৃষ্টি দরকার। বৃষ্টির পরিমাণ আর সময়, দুটোই খুব জরুরি। ফুল ফোটার পর ঠিকমতো বৃষ্টি না হলে চেরি ঠিকভাবে বাড়ে না। আবার, চেরি তোলার সময় বেশি বৃষ্টি হলে ফলের কোয়ালিটি নষ্ট হয়ে যায়।
সূর্যালোক ও ছায়া (Sun & Shade): কফি গাছ সরাসরি তীব্র রোদ ভালোভাবে নিতে পারে না। বড় গাছের ছায়ায় জন্মানো কফি ধীরে ধীরে পাকে, তাই এর স্বাদ মিষ্টি আর ভালো ব্যালেন্সড হয়। সরাসরি রোদে জন্মানো কফি বেশি হয়, কিন্তু স্বাদ কম ভালো হয়।
তাপমাত্রা (Temperature): কফি চাষের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হলো ১৫°C থেকে ২৫°C। তাপমাত্রা এর চেয়ে বেশি বা কম হলে গাছের বৃদ্ধি আর ফলের কোয়ালিটি দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
Terroir-এর কারণেই এক এক দেশের কফির স্বাদ এক এক রকম। চলুন, কয়েকটি বিখ্যাত অঞ্চলের কফির স্বাদ চিনে নিই।
ইথিওপিয়া (Ethiopia): কফির জন্মভূমি বলা হয় ইথিওপিয়া-কে। এখানকার উঁচু পাহাড়ি এলাকার terroir কফিকে দেয় দারুণ floral (জেসমিনের মতো) আর fruity (ব্লুবেরি, লেবুর মতো) স্বাদ। এর অ্যাসিডিটি খুব উজ্জ্বল (bright) এবং বডি হয় চায়ের মতো হালকা।
কলম্বিয়া (Colombia): অ্যান্ডেস পর্বতমালার উঁচু ঢালে জন্মানো কলম্বিয়ান কফির স্বাদ খুব ব্যালান্সড। এতে বাদাম এবং চকলেটের নোটসের সঙ্গে হালকা ফলের মতো মিষ্টি অ্যাসিডিটি পাওয়া যায়।
সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া (Sumatra, Indonesia): এখানকার terroir এবং বিশেষ প্রসেসিং পদ্ধতি (Giling Basah) কফিকে দেয় একেবারেই আলাদা স্বাদ। এর বডি খুব ভারী (heavy), অ্যাসিডিটি কম, এবং স্বাদ হয় মাটির মতো, মশলাদার এবং ধোঁয়াটে।
ব্রাজিল (Brazil): দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কফি উৎপাদক দেশ হলো ব্রাজিল। ব্রাজিলের কফি মূলত নিচু এলাকায় চাষ হয়। এর স্বাদ হয় মাইল্ড, বাদামের মতো (nutty) এবং চকলেটের মতো (chocolatey)। অ্যাসিডিটি কম থাকায় এটি এসপ্রেসো ব্লেন্ডের জন্য একদম উপযুক্ত।
Terroir হলো কফির জন্মপরিচয়। এটা শুধু একটা ভৌগোলিক ঠিকানা নয়, বরং এটা কফির আত্মা। একটা কফি বিনের ভেতর তার জন্মস্থানের মাটি, পানি, বাতাস আর সূর্যের গল্প লেখা থাকে। রোস্টিং আর ব্রিউইং সেই গল্পটাকে আমাদের কাপ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
তাই, পরের বার যখন আপনি single-origin coffee পান করবেন, একটু থেমে তার স্বাদে জন্মভূমি চিনার চেষ্টা করুন। হয়তো আপনি খুঁজে পাবেন কেনিয়ার রোদ ঝলমলে পাহাড় বা সুমাত্রার বৃষ্টিভেজা জঙ্গল। এই terroir-এর যাত্রাই কফিকে এত বিশেষ এবং বৈচিত্র্যময় করে।
আরো পড়ুন: কফি কী? এর প্রকারভেদ আর পেছনের গল্প।