No products in the cart.

কফি কী? এর প্রকারভেদ আর পেছনের গল্প

সকালে ঘুম থেকে উঠে, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়, বা কাজের ফাঁকে একটু ফ্রেশ হতে, কফি ছাড়া অনেকেরই চলে না। কফি শব্দটা শুনলেই মনটা কেমন চাঙ্গা হয়ে যায়। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের প্রতিদিনের সঙ্গী এই কফি। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, এই যে প্রতিদিন কফি খাই, এটা আসলে কী? কোথা থেকে আসে? আর কত রকমের হয়?

আজ আমরা চলুন কফির জগতটা একটু ঘুরে দেখি। আমাদের সবার প্রিয় কফির পেছনের গল্পটা জেনে নিই।

কফি জিনিসটা আসলে কী?

খুব সহজভাবে বলতে গেলে, কফি হলো এক ধরনের ফল থেকে পাওয়া ভাজা বিচির বা বিনের গুঁড়া। এই ফলটা জন্মে কফি গাছে। গাছগুলো দেখতে অনেকটা ঝোপের মতো হয় আর তাতে লাল বা পার্পল রঙের ছোট ছোট ফল ধরে, যেগুলোকে আমরা কফি চেরি বলি।

প্রত্যেকটা চেরির ভেতরে সাধারণত দুটো করে বিচি থাকে। এই বিচিগুলোকেই আমরা কফি বিন বলি। বিনগুলো গাছ থেকে তোলা হয়, শুকানো হয়, ভাজা (রোস্ট) করা হয়, তারপর গুঁড়া করা হয়। সেই গুঁড়া গরম পানির সঙ্গে মিশিয়েই তৈরি হয় আমাদের প্রিয় কফি। তো, পরেরবার যখন কফি খাবেন, মনে রাখবেন, আপনি আসলে একটা ফলের বিচি থেকে তৈরি দারুণ কিছু উপভোগ করছেন।

কফির জন্ম কোথায়? (এক ছাগল পালকের গল্প)

কফির আবিষ্কার নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প আছে। তবে সবচেয়ে পরিচিত গল্পটা হলো ইথিওপিয়ার এক ছাগল পালক আর তার ছাগলদের নিয়ে।

গল্পটা এমন যে অনেক দিন আগে, ক্যালডি নামের এক ছাগল পালক দেখলো, তার ছাগলগুলো এক ধরনের অচেনা গাছের লাল ফল খেয়ে খুব লাফালাফি করছে। তাদের এনার্জি যেন শেষই হচ্ছে না। কৌতূহলী হয়ে ক্যালডি নিজেও কয়েকটা ফল চেখে দেখলো, আর সাথে সাথে তারও শরীরে দারুণ এক ফুর্তি চলে এলো।

এই আবিষ্কারের কথা সে কাছের এক মঠের সন্ন্যাসীকে জানায়। সন্ন্যাসী প্রথমে ফলগুলোকে শয়তানের কারসাজি ভেবে আগুনে ফেলে দেন। কিন্তু আগুনে পোড়ার পর বিনগুলো থেকে এমন সুন্দর একটা গন্ধ বের হতে শুরু করে যে, তিনি ও অবাক হয়ে যান। তিনি পোড়া বিনগুলো পানি দিয়ে নিভিয়ে দেন এবং সেই পানিটুকু পান করে দেখেন। এরপর সারা রাত তার আর কোনো ঘুম আসে না, বরং তিনি খুব সতেজ বোধ করেন।

এভাবেই নাকি কফির জন্ম। যদিও এটা শুধু একটা গল্প, তবে ঐতিহাসিকরা একমত যে, কফির যাত্রা শুরু হয়েছিল ইথিওপিয়ার উঁচু মালভূমিতে। সেখান থেকে আরব বণিকদের মাধ্যমে কফি ইয়েমেনে পৌঁছায় এবং ধীরে ধীরে পুরো মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং শেষে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

কফির প্রধান প্রকারভেদ

পৃথিবীতে প্রায় ১০০-এর বেশি প্রজাতির কফি গাছ আছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে মূলত চার ধরনের কফি বিন চাষ করা হয়। এর মধ্যে দুটো সবচেয়ে জনপ্রিয় যথা: অ্যারাবিকা আর রোবাস্টা।

১. অ্যারাবিকা (জনপ্রিয়)

বিশ্বের প্রায় ৬০% কফিই হলো অ্যারাবিকা। এটা সবচেয়ে জনপ্রিয় আর বহুল ব্যবহৃত কফি বিন। যারা ভালো মানের, স্মুথ ফ্লেভারের কফি পছন্দ করেন, তাদের জন্য অ্যারাবিকা সেরা।

স্বাদ: অ্যারাবিকা কফির স্বাদ কিছুটা মিষ্টি, সফট আর এতে হালকা ফলের মতো বা ফুলের মতো ফ্লেভার থাকে। এর অ্যাসিডিটি বা অম্লতা বেশি, যা কফিকে একটা উজ্জ্বল আর রিফ্রেশিং স্বাদ দেয়।

ক্যাফিন: এতে রোবাস্টার তুলনায় ক্যাফেইনের পরিমাণ কম থাকে। তাই যারা ক্যাফেইনের প্রতি একটু বেশি সংবেদনশীল, তাদের জন্য এটা ভালো।

চাষ: এই কফি চাষ করা বেশ কঠিন। এটা উঁচু পাহাড়ি এলাকায়, নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আর বৃষ্টিপাতের মধ্যে ভালো জন্মায়। যেহেতু এর যত্ন বেশি নিতে হয়, তাই এর দামও তুলনামূলকভাবে বেশি। ভালো মানের কফি বলতে আমরা সাধারণত অ্যারাবিকাকেই বুঝি।

২. রোবাস্টা (শক্তিশালী)

নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এটা বেশ শক্তিশালী বা রোবাস্ট। বিশ্বের প্রায় ৩০% কফি রোবাস্টা। যারা খুব কড়া আর তেতো কফি পছন্দ করেন, তাদের কাছে রোবাস্টা দারুণ জনপ্রিয়।

স্বাদ: রোবাস্টার স্বাদ অনেক বেশি কড়া, তেতো আর অনেকটা রাবারের মতো বা ডার্ক চকোলেটের মতো হয়। এর ফ্লেভার অ্যারাবিকার মতো এত মিষ্টি বা মসৃণ নয়।

ক্যাফিন: এতে অ্যারাবিকার প্রায় দ্বিগুণ ক্যাফেইন রয়েছে। তাই যারা খুব শক্তিশালী কফি হিট চান তাদের জন্য রোবাস্টা উপযুক্ত।

চাষ: রোবাস্টা অ্যারাবিকার তুলনায় চাষ করা সহজ। এটি গরম আবহাওয়া এবং যেকোনো পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। তাই, এটির দামও কম। ইনস্ট্যান্ট কফি এবং এসপ্রেসো মিশ্রণে রোবাস্টা প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি একটি দুর্দান্ত ‘ক্রিমা’ (এসপ্রেসোর উপরে সোনালী ফেনা) তৈরি করে।

৩. লাইবেরিকা (দুর্লভ)

এই কফিটা খুব দুর্লভ। বিশ্বের মোট কফি উৎপাদনের মাত্র ২% হলো লাইবেরিকা। এটা সহজে পাওয়া যায় না এবং এর স্বাদও বেশ অন্যরকম।

স্বাদ: এর স্বাদ খুবই ইউনিক। এর স্বাদ কিছুটা ধোঁয়াটে, ফলের এবং ফুলের সুবাস রয়েছে, যা সবার পছন্দ নাও হতে পারে।

চাষ: এই কফি ফিলিপাইনে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। এর ফল অন্যান্য কফি চেরির তুলনায় আকারে অনেক বড়।

৪. এক্সেলসা (দারুণ আলাদা স্বাদ)

এক্সেলসাকে এখন লাইবেরিকার একটা জাত হিসেবেই ধরা হয়। এর উৎপাদনও খুব কম।

স্বাদ: এর স্বাদ টক আর ফলের মতো হয়। কফি ব্লেন্ডে ব্যবহার করলে স্বাদে নতুন মাত্রা বা কমপ্লেক্সিটি যোগ হয়।

চাষ: মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে এর চাষ হয়।

কফি তৈরির কিছু জনপ্রিয় উপায়

শুধু ভালো বিন হলেই কিন্তু চলবে না, কফি তৈরির পদ্ধতির ওপরও এর স্বাদ অনেকখানি নির্ভর করে। বিশ্বজুড়ে কফি বানানোর অনেক উপায় আছে। চলুন কিছু জনপ্রিয় পদ্ধতি দেখে নিই।

এসপ্রেসো (Espresso): এটা কফি তৈরির সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায়গুলোর একটা। এসপ্রেসো মেশিনে খুব অল্প পরিমাণ গরম পানিকে উচ্চ চাপে কফি পাউডারের মধ্যে দিয়ে চালনা করা হয়। এর ফলে খুব ঘন আর কড়া এক শট কফি তৈরি হয়। ল্যাটে, ক্যাপুচিনো, আমেরিকানো – এই সবকিছুর বেস হলো এসপ্রেসো।

ডালগোনা কফি (Dalgona Coffee): এই কফিটা তো বাংলাদেশে রীতিমতো ভাইরাল! ইনস্ট্যান্ট কফি, চিনি আর গরম পানি একসাথে ফেটিয়ে একটা ফোম তৈরি করা হয় এবং সেটা ঠাণ্ডা বা গরম দুধের ওপর দিয়ে পরিবেশন করা হয়। দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমন মজার।

ফ্রেঞ্চ প্রেস (French Press): এটা বাসায় ভালো কফি বানানোর জন্য খুব সহজ একটা উপায়। একটা কাচের জগে কফি গুঁড়া আর গরম পানি একসাথে মিশিয়ে কয়েক মিনিট রেখে দেওয়া হয়। তারপর একটা ফিল্টার দিয়ে চাপ দিয়ে কফি আর পানি আলাদা করা হয়। এতে খুব ফুল-বডিড আর রিচ ফ্লেভারের কফি পাওয়া যায়।

মোক্কা পট (Moka Pot): ইতালির ঘরে ঘরে এই জিনিসটা দেখতে পাওয়া যায়। এটা স্টোভের ওপর বসিয়ে কফি বানানো হয়। পানি গরম হয়ে স্টিম তৈরি করে এবং সেই চাপে পানি কফি পাউডারের মধ্যে দিয়ে ওপরে উঠে আসে। এতে এসপ্রেসোর মতো কড়া কফি তৈরি হয়।

কফি কি স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?

কফি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা আছে। কেউ বলে ভালো, কেউ বলে খারাপ। সত্য এটাই যে, পরিমিত পরিমাণে কফি পান করলে এর বেশ কিছু স্বাস্থ্যকর দিক আছে।

এনার্জি বাড়ায়: কফিতে থাকা ক্যাফেইন আমাদের ক্লান্ত ভাব দূর করে আর ব্রেইনকে সতেজ করে। কাজের মনোযোগ বাড়াতে এর জুড়ি নেই।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর: অবাক হলেও সত্যি যে, কফিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এই উপাদান আমাদের শরীরকে ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে।

কিছু রোগ প্রতিরোধে সহায়ক: গবেষণা বলছে, নিয়মিত কফি পান করলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস, পারকিনসনস ডিজিজ এবং কিছু লিভারের রোগের ঝুঁকি কমে।

মেটাবলিজম বাড়াতে পারে: ব্ল্যাক কফি ক্যালোরি-ফ্রি এবং এটা মেটাবলিজম বাড়িয়ে ফ্যাট বার্ন করতে সাহায্য করতে পারে। তাই ওজন কমানোর যাত্রায় এটা আপনার সঙ্গী হতে পারে।

তবে মনে রাখবেন, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। দিনে ৩-৪ কাপের বেশি কফি খেলে ঘুমের সমস্যা, অস্থিরতা বা অ্যাসিডিটির মতো সমস্যা হতে পারে।

আরো পড়ুন: বিভিন্ন ধরনের কফি খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত জানুন

কফি আর আমাদের সংস্কৃতি

কফি এখন আর শুধু একটা সাধারণ কিছু নয়। এটা আমাদের সংস্কৃতির একটা বড় অংশ হয়ে গেছে। বন্ধুত্বের আড্ডা, অফিসের মিটিং, কিংবা একাকী বই পড়া – সবকিছুর সাথেই কফি জড়িয়ে আছে।

সোশ্যাল কানেকশন: কফি শপগুলো এখন মানুষের দেখা করার আর আড্ডা দেওয়ার প্রিয় জায়গা। “চলো, কফি খাই” কথাটা এখন দেখা করার একটা সহজ উপায়। এটা আমাদের সামাজিক সম্পর্কগুলোকে আরও মজবুত করে।

অভিজ্ঞতা: ভালো মানের কফি পান করা এখন অনেকের কাছে একটা অভিজ্ঞতার মতো। কোন বিন, কোন রোস্ট, কীভাবে তৈরি করা হলো – এই সবকিছু মিলে কফি উপভোগ করার আনন্দটাই অন্যরকম।

ওয়ার্ক কালচার: অফিসের কাজের ফাঁকে এক মগ কফি যেন নতুন করে শক্তি যোগায়। অনেক বড় বড় আইডিয়া আর প্ল্যান কিন্তু এই কফির আড্ডাতেই জন্ম নেয়।

শেষ কথা

কফির জগৎটা আসলেই বিশাল আর বৈচিত্র্যময়। একটা সাধারণ ফলের বিচি থেকে শুরু করে আমাদের মগে পৌঁছানো পর্যন্ত এর যাত্রাটা বেশ লম্বা আর আকর্ষণীয়। ইথিওপিয়ার এক ছাগল পালকের আবিষ্কার থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই পানীয়তে পরিণত হওয়া – কফির গল্পটা সত্যিই অসাধারণ।

তো, পরেরবার যখন কফি খাচ্ছেন, এক মুহূর্ত ধ্যান দিয়ে ভাবুন এর যাত্রা। ভাবুন, আপনার হাতে থাকা এই মগের পেছনে লুকিয়ে আছে শত শত বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর অসংখ্য মানুষের পরিশ্রম। তখন কফি উপভোগের মুহূর্তটা আরও বিশেষ হয়ে উঠবে। আপনার পরের কাপটা হোক একটু স্পেশাল।

Share:

Picture of আরিফ চৌধুরী

আরিফ চৌধুরী

আরিফ চৌধুরী একজন পরিবেশ সাংবাদিক এবং কফি চাষ গবেষক যিনি টেকসই কফি উৎপাদন, ন্যায্য বাণিজ্য এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার উন্নতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করেন।

Add comment

Your email address will not be published. Required fields are marked

Related Articles